গরিব কাল ।

গরিব কাল.””””””””’ ।

হটাত গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় । একটু এপাশ-ওপাশ করি, তারপর আবার ঘুমাই । চৌকিতে বাবার সাথে ঘুমাই । মেঝেতে মা আর অন্য চার ভাই-বোন । আমি বাড়ির বড় ছেলে । বাবা খুব ভালবাসতেন আমাকে । আমিও বাবা ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না । ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেটি এখনো পারলে বাবার কোলে চড়ে বসি । বাবাও পারলে তাকে কোলে নেন । অফিসে যাওয়ার সময় বাবা একবার আমার মাথায় হাত রাখবেনই । রাতে বাবার আসতে দেরি হলে আমি গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি । মা এজন্য প্রায়ই রেগে যেতেন । বাবার জন্য এতো আহ্লাদ ভালো না! বাবাকেও বলেন এই কথা । বাবা-আমি কেউ গা করি না ।
.আজ রাতে ঘুম ভেঙে হটাত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল । বাবা বিছানায় বসে আছেন । জানালা দিয়ে চাঁদের এক টুকরো আলো এসে পড়েছে বাবার মুখে । সেই আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বাবা নিঃশব্দে কাঁদছেন । কান্নার জলে গাল ভেসে যাচ্ছে । দেখে আমার বুকটা কেঁদে উঠল ।

এভাবে কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে?
মা আর অন্য ভাই-বোনরা ঘুমে আছেন । বাবার কান্না দেখে উঠে বসতে চাইলাম । বাবা বুজতে পেরে গেলেন । এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে অন্য হাত রাখলেন আমার ঠোঁটে । বুঝলাম, বাবা চাইছেন আমি যেন কোনও শব্দ না করি ।
.
বাবা শুয়ে পড়লেন । আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে বললেন, ঘুমাও বাবা । কাল তোমার সঙ্গে কথা বলবো ।
.আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । ঘুম হলো না । মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন । বোধহয় নিঃশব্দে কাঁদছেনও ।

পরদিন অফিসে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে চুপিচুপি বললেন, সন্ধ্যা ছ’টার দিকে বটতলার ওখানে আসিস । কাউকে কিছু বলবিনা না ।
.আমি মাথা নাড়লাম ।

চোখে দিশেহারা, চিন্তিত দৃষ্টি । পনেরো ভাড়াটের চেয়ে সামান্য উন্নত বাড়ির গেটের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে হেঁটে গেলেন, দেখে আমার বুক তোলপাড় করতে লাগল । স্কুলে গেলাম ঠিকই কিন্তু মন বসল না । না ক্লাস ভালো লাগল, না বন্ধুদের সঙ্গ । শুধু মনে হতে থাকে কখন ছ’টা বাজবে । কখন গিয়ে দাঁড়াব বটতলার সামনে । কখন বাবা আসবে! কী হয়েছে বাবার? রাতে ওভাবে কাঁেদছিলেন কেন?
.বাবার কান্নার দৃশ্যটা দেখে ততবারই কান্না পায় । এমন অসহায়, নিঃশব্দ কান্না কেন কাঁদলেন আমার বাবা? অন্য কাউকে কেন বুঝতেও দিতে চাইল না? কী হয়েছে?
.
স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে আসতে চারটা বাজে । ভাত খেয়ে চলে যাই মাঠে । পাড়ার ছেলেরা, ফুটবল খেলে মাঠে । মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় । শীত চলে গেছে । গরম এখনো তেমন পড়েনি । আবহাওয়া ভালো ।
.আমি খেলাধুলা পারি না । তবু ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করি । আজ তাও করি নি । মাঠের ধারে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ । কেউ কেউ খেলতে ডাকল । গেলাম না । কাল রাতের দৃশ্যটা ভুলতে পারছি না । বাবা কেন কাঁদছিলেন? যতবার কথাটা ভাবি ততবারই বাবার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে । বুক তোলপাড় করে ।

কাঠেরপুলের পুব পাশে বিশাল বটগাছ । বটতলায় একটা পান বিড়ি সিগারেটের দোকান । সঙ্গে চা ও বিক্রি হয় । সেই দোকানটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি । সন্ধ্যা নেমে আসে । বাবা আসেন না কেন । আমি দাঁড়িয়ে থাকি । ধীরে ধীরে দোকানপাটে জ্বলে ওঠে আলো । রাস্তায় জ্বলে ওঠে । বাবা আসেন না । আমি অপেক্ষায় থাকি । বুকের ভেতরটা ধরপর করে! কী কথা আমাকে বলবে বাবা, যে-কথা বাসায় বলা যাবে না! অন্য কারো সামনে বলা যাবে না!
.বাবা এলেন অনেক দেরি করে । কাঠেরপুল পেরিয়ে এলেন বিপর্যস্ত মানুষের ভঙ্গিতে । হাঁটাচলায় গভীর অসহায়ত্ব । পরনে জীর্ণ পায়জামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি । কনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো । কাছাকাছি আসার পর দেখি মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে । বোধহয় সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি । আমাকে দেখে হাসলেন । এসেছো বাবা?

অনেকক্ষণ আগেই এসেছি । তুমি এতো দেরি করলে কেন বাবা? মুখটা এতো শুকনো কেন বাবা? দুপুরের ভাত খাওনি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন বাবা । তোমরা কী দিয়ে খেলে? সকালবেলা তো বাজার করিনি!

আমরা খিচুড়ি খেয়েছি ।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।

বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী হয়েছে বাবা?
.সে-কথা বলার জন্যই তোমাকে এখানে আসতে বলেছি । সারাদিন অনেক হাঁটাহাঁটি করেছি । পা দুটো ভেঙে আসছে । চলো ওদিকটায় বসি । বসে কথা বলি ।

বটগাছটার পিছনে মাঠ । তারপর তিনটা সরকারি গুদাম । বিশাল লম্বা লম্বা ঘর । এখন একদম নীরব । কেউ নেই । বাবা আমাকে নিয়ে সেখানটায় এলেন । খোলা মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে বসলেন । বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তাঁর । সেই দীর্ঘশ্বাস আমার একেবারে কলিজাই এসে লাগল ।
কী হয়েছে, বাবা?
.
বাবা কথা বললেন না । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ।
বাবার কান্না দেখে আমি একটু থতমত খেলাম । তারপর আমিও কাঁদতে লাগলাম । বাবাকে আমি কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি । রাতে প্রথম দেখলাম । নিঃশব্দে কাঁদছিলেন । আজ দেখছি প্রকাশ্যে । বাবার কান্না সহ্য করা আমার পক্ষে আসম্ভব । কাল রাতের কান্না দেখে ঘুমাতে পারিনি । সারাটা দিন নিঃশব্দ করুণ কান্নার কথা ভেবে বারবারই চোখে পানি এসেছে । আর এখন আমার সামনে বসে শিশুর মতো কাঁদছেন, এই কান্না কেমন করে সহ্য করব? কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম । কী হয়েছে বাবা বলো আমাকে ।
.
এক হাতে চোখ মুছতে অন্য হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা । জড়ানো গলায় কোনো রকমে বললেন, দু-মাস ধরে বেতন বন্ধ । আমাকে সাসপেন্ড করে দিয়েছে ।
.শুনে আঁতকে উঠলাম ।‘সাসপেন্ড’ব্যাপারটা বুঝি । বাবার মুখেই শুনেছি । অস্থির গলায় বললাম, কী বলছো, বাবা? সাসপেন্ড করেছে তোমাকে?
.
বাবা মাথা নাড়লেন । হ্যাঁ । অফিসের টাকা থেকে সাতশো টাকা সংসারের জন্য খরচ করেছিলাম গত কয়েক মাসে । সময় মতো টাকা টা জমা দিতে পারিনি । জানাজানি হওয়ার পর সাসপেন্ড করে দিয়েছে ।
বাবা আবার কাঁদতে লাগলেন । সাড়ে তিনশো টাকা বেতন পেতাম । পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে, বাসা ভাড়া দিয়ে চলতে পারি না । নুন আনতে পান্তা ফুরায় । ধার করে, এদিক-ওদিক করে কত কষ্ট করে যে চলি! তারপরও চাকরিটা ছিল, কোনো রকমে চলতে পারছিলাম । দু-মাস হলো চাকরিই নেই । ধার-কর্জ করতে করতে ডুবে গেছি । বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে । যখন-তখন বাড়ির মালিক বাসা ছাড়তে বলবে । এখন টাকা ধার পাই না । আজ সারাটা দিন কত জায়গায় যে গেলাম! কতজনের কাছে হাত পাতলাম! আট আনা পয়সাও কেউ দিলো না ।
.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *